রূপান্তরকামী হয়ে ভারতে পাসপোর্টের জন্য কিভাবে আবেদন করবেন?
আমি দ্রুত আমার জেঠিমার তৈরি গরম কফি শেষ করে ঘরে ফিরে আসি এবং একজন রূপান্তরকামী নারী হিসাবে কীভাবে পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন করতে হবে সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করি । হাজার হাজার চিন্তা আমার মাথার মধ্য ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি আমার মাথায় জোরে জোরে টিপে চাপ কমানোর চেষ্টা করলাম।
তাই আমি এই প্রজন্মের প্রতিটি সদস্য যা করে তাই করলাম “গুগল”। আমি “একটি রূপান্তরকামী মহিলা হিসাবে পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন” লিখে সার্চ করলাম এবং শুধুমাত্র বিদেশী দেশের এই সম্পর্কিত আইনের ব্যাপারে লেখা কিছু নিবন্ধ খুঁজে পেলাম যাতে খুব হতাশ হয়েছিলাম। আমি হতাশ হয়েছি যে আমাদের দেশটি ডিজিটাল জগতে অনেক পিছিয়ে আছে যখন অন্যান্য দেশগুলি উন্নত এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা নাগরিকদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। ইন্টারনেটে ভারতীয় পাসপোর্ট ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি হিসাবে আবেদন করার জন্য কোনো পদ্ধতির বিস্তারিত কোনও অনুসন্ধান ফলাফল ছিল না।
আমি ভাবলাম যদি জনপ্রিয় পাসপোর্ট সহায়তা সংস্থাগুলি এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। প্রথমবারের মতো তারা রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের জন্য পাসপোর্ট অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাপারে শুনলো। তারা কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারল না যে আমি আমার পাসপোর্টে একটি “F” লিঙ্গ চিহ্ন পেতে পারি যা আমি মনেপ্রাণে চাই। তারা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নথি আমার কাছে চেয়েছিল: আমার জন্মের সার্টিফিকেট, SSCA এবং বর্তমান ঠিকানার প্রমাণ, সৌভাগ্যক্রমে আমার আধার কার্ডে আমার নতুন নাম এবং লিঙ্গ পরিবর্তন করা ছিল। যদিও ভারতে পাসপোর্ট আবেদনের ফর্মগুলিতে “M” এবং “F” এর সাথে “T” মার্কার অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে , তবে ভারতীয় রূপান্তরকামী নাগরিকদের জন্য এ সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনও বিস্তারিত বিবরণ বা গাইড নেই|
আমি যে পাসপোর্ট সংস্থাকে বেছে নিয়েছিলাম তারা মিডিয়ার আকর্ষণের ভয় পেত কারণ আমি তাদের বলেছিলাম যে পাসপোর্ট অফিস আমার পাসপোর্টে “F” লিঙ্গ চিহ্ন অস্বীকার করলে আমি মিডিয়াকে জানাব । আমি তাদের থেকে একটাই ভালো পরামর্শ পেয়েছিলাম — তারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আমার সমস্ত দস্তাবেজ নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রে (PSK) যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল যে কিভাবে একজন রূপান্তরকামী নারী হিসাবে আমি একটি পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন করতে পারি।
পরে, আমি ট্রান্সজেন্ডার ইন্ডিয়াকে ফোন করেছিলাম। তারা আমাকে দৃঢ় থাকতে বলে এবং আনন্দের সঙ্গে এই যুদ্ধে লড়াই করার জন্য উৎসাহিত করে এবং বলে পাসপোর্ট অফিসারদের এ বিষয়ে অবগত করতে বিনয় প্রদর্শন করি, যদি তারা আমাদের দেশের ট্রান্স জেন্ডার আইন ও বর্তমান ঘটনাবলি সম্পর্কে না জেনে থাকেন | সুতরাং তাদের পরামর্শের কথা মনে রেখে , আমি অনলাইনে সরকারি পাসপোর্ট পোর্টালে একটি অ্যাকাউন্ট খুলি , আবেদনটি পূরণ করি এবং অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য একটি তারিখ পাই।
তাই সেখানে আমি ক্ষীন আস্থা নিয়ে দাড়িয়েছিলাম ও তদন্ত অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এর জন্য আমাকে কী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে ? তিনি খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং আমাকে যে সমস্ত দলিল প্রমাণ করে যে আমি একজন রূপান্তরকামী নারী যিনি বৈধভাবে নিজের নাম ও লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন সেগুলি আমাকে দিতে বলেন । ভাগ্যবান আমি, আমার কাছে সেই মুহুর্তে আমার নাম এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের একটি হলফনামা বা এফিডেভিট ছিল। আমি দুটি সংবাদপত্রে একটি কন্নড়ের স্থানীয় সংবাদপত্র এবং ইংরেজীতে এক জাতীয় সংবাদপত্রে আমার নাম পরিবর্তনের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছি। আমার আইনজীবী পরামর্শে আমি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি করিনি কারণ সেটা কষ্টসাধ্য | আমার গেজেটে বিজ্ঞপ্তি না করা নিয়ে একটু ভয় ছিল। তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে একটি ডকুমেন্ট নোটোরাইজ করতে বলেছিলেন এবং আমাকে “Annexure E” দিয়েছিলেন যা বিশেষভাবে পাসপোর্ট এ নাম পরিবর্তন প্রমাণ করার জন্য লেআউট।
আমি সকালে তাড়াতাড়ি উঠি এবং সকালের প্রার্থনায় কেবলমাত্র একটিই চিন্তা আমার মনের মধ্যে ছিল , “হে প্রভু, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন”। আমি লালবাগ পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রে (PSK) একটি ওলা শেয়ার ক্যাব নিয়ে পৌছালাম | আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে সেখানে প্রবেশ করলাম এবং টোকেন কাউন্টারে গেলাম যেখানে তারা আপনাকে এমন একটি সংখ্যা দেবে , যা আপনার এই গোটা প্রক্রিয়ায় কাজে লাগবে যতক্ষণ না আপনি ওই অফিস থেকে বেরিয়ে আসছেন ।
আমি টেবিলে বসা কর্মী আমার নথি দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেবে সেই ব্যাপারে চিন্তিত ছিলাম | সৌভাগ্যবশত তারা ডকুমেন্ট দেখতে ক্লান্ত ছিল। পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করার আগে আমি তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ফটোকপিগুলিতে স্বাক্ষর করিনি । তারা একটি বাদামী কাগজে আমার সমস্ত দস্তাবেজ ভরে এবং কাউন্টারের প্রবেশদ্বারে যেতে আমাকে নির্দেশ দেয় । প্রবেশদ্বারে একজন নিরাপত্তা রক্ষী ছিল যিনি আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের প্রিন্ট আউটে থাকা বারকোড স্ক্যান করেন এবং আপনাকে ভিতরে যেতে দেন । ভিতরে ঢুকে আমি সেখানে বিশাল জনতার ভিড় দেখতে পাই যারা অত্যন্ত ক্লান্তির সঙ্গে বিশাল মনিটরের দিকে তাকিয়েছিল কখন তাদের টোকেন নম্বর ও সেই সঙ্গে কোন কাউন্টারে তাদের যেতে হবে, সেটা প্রদর্শিত হবে| তিনটি কাউন্টার আছে A, B, C এবং একজন APO যিনি একটি আলাদা কেবিনে বসেন ।
আমি জানতে পারি যে A কাউন্টারটি দস্তাবেজ সম্পাদনা, স্ক্যান এবং সার্ভারে আপলোড করে। B কাউন্টারে সব নথিপএ যাচাই করা হয় । C কাউন্টারে সিনিয়র অফিসাররা চূড়ান্ত যাচাই করেন এমন নথিপএ যা হয়তো কাউন্টার B মিস করে গেছে । আমি A কাউন্টারে ঢোকার জন্য ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম | অবশেষে ঢোকার পর তারা প্রথমে একজন রূপান্তরকামী ব্যক্তির নথি প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে সাহায্য নিতে ভিতরে গেলেন ও আমাকে অপেক্ষা করতে বলে গেলেন | অবশেষে তারা ফিরে এলেন এবং নিয়ম অনুসারে স্পটে আমার ছবি তুললেন , আমার আঙুলের ছাপ নিলেন ইত্যাদি |
এদিকে B কাউন্টারের অফিসারকে ভীতিকর মনে হচ্ছিল কারণ আমার আগে একজনের উপর তিনি উপযুক্ত নথি তৈরি না করার জন্য চিৎকার করেছিলেন। তিনি আমার নথি দেখে নিয়ে আমাকে একটু কড়া নজরে দেখলেন এবং আমার সকল দস্তাবেজ যাচাই করে আমাকে C কাউন্টারে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন । টোকেন নথিভুক্তির ডিসপ্লেটি দেখে আমার মনে হল যে এইটা এতটাত্ত খারাপ ছিল না | কিন্তু পরে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন C কাউন্টারে থাকা অফিসার আমাকে বললেন আমি যেন একটি সরকারি হাসপাতালের সার্টিফিকেট বা চিঠি নিয়ে আসি যাতে উল্লেখ থাকবে যে আমি সত্যিই জেন্ডার আইডেনটিটির সমস্যায় ভুগি এবং আমি আমার বাকী জীবনটা একজন মহিলা হিসাবে বাঁচতে চাই | আমি তার কাছে যে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখিয়েছিলাম সেটি ছিল একটি বেসরকারী হাসপাতালের ডকুমেন্ট। তারপর তিনি আমাকে APO এর সঙ্গে দেখা করতে বললেন যিনি নিজস্ব কেবিনে বসেন |আবার আমি আবার ডিসপ্লে মনিটরের সামনে গিয়ে বসলাম এবং কিছুক্ষণ পরে আমার টোকেন নম্বরের পাশে APO শব্দটি ভেসে উঠল | আমি এরপর APO এর কেবিনে ঢুকলাম , মহিলা অফিসারকে শুভেচ্ছা জানালাম এবং যখন তিনি দ্রুত আমার সমস্ত দস্তাবেজ দেখছিলেন, তখন আমি প্রথম হতাশ হয়েছিলাম কারণ তিনিও এই ডাক্তারের সার্টিফিকেটে বিশ্বাসী ছিল না কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথনের পর তিনি বলেছিলেন যে তিনি আমাকে রেফার করবেন করমঙ্গলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার জন্য এবং দুই দিন পরে সেই অফিসে আমাকে যেতে বললেন। আমি খুব শীঘ্রই ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম এবং লাইনে আরও অনেকে ছিল, এরপর আমাকে প্রস্থান কাউন্টারের দিকে যেতে বলা হল যেখানে পাসপোর্ট আবেদনপত্রর প্রিন্ট আউট নেওয়া হচ্ছিল।
আমি আমার পাসপোর্টের স্টেটাসে “অপেক্ষারত” খুঁজে পেতে হতাশ হলাম। আমি ভাবলাম যে আমাকে আবারও মেডিক্যাল ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে । আমি আমার বাগদত্তের সাথে কথা বলেছিলাম, ও আমাকে উৎসাহিত করেছিল এই বলে যে এটি খুবই ক্ষুদ্র ব্যাপার এবং আমার সব দস্তাবেজ অনুমোদন ও প্রমাণিত হয়ে যাওয়ায় আমাকে আনন্দিত করেছিল।
সকালে উঠে আমি প্রস্তুত হই এবং আবার আমার স্বাভাবিক ওলা শেয়ার ক্যাব নিই। আমি প্রায সাড়ে সাতটায় গিয়েছিলাম গিয়েই একটি ফাঁকা আসন দখল করব বলে, আমি এটা জানতাম কারণ আমি আগেই এই আঞ্চলিক অফিসটি সম্পর্কে গুগল রিভিউ পড়ে নিয়েছিলাম ।
টোকেন কাউন্টার ঠিক ৯ টায় খোলে এবং আমি লাইনের মধ্যে আট নম্বর ব্যক্তি ছিলাম যা আমাকে আমার প্রক্রিয়াটি প্রথম দিকে শুরু করতে সাহায্য করেছিল । আমাকে বাড়িটির মধ্যে বিভিন্ন কাউন্টারে যেতে বলা হয়েছিল। এবং অবশেষে আমি একজন খুব শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী মহিলা অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করলাম যিনি আমার আবেদনটি খুবই বিনয় ও সহানুভূতির সাথে গ্রহণ করেছিলেন। আমি তাকে জানাই যে আমি আমার পাসপোর্টে “F” লিঙ্গচিহ্ন চাই কারণ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে যে আমরা হরমোন চিকিৎসা বা অস্ত্রোপাচার ছাড়াও আমাদের অফিসিয়াল নথিগুলিতে তিনটি লিঙ্গ চিহ্নের যে কোনো একটি বেছে নিতে পারি। তিনি আশ্চর্য্যজনক্ভাবে আমাকে বিস্মিত করে দৃঢ়ভাবে হ্যাঁ বললেন | আমি যা যা দেখাতে পারতাম, আমার রক্তের কাজ, হরমোনের মাত্রার রেকর্ড, আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান ইত্যাদি দেখিয়েছিলাম … আমি তাকে বললাম যে আমি থাইল্যান্ডে অস্ত্রোপচার করাতে চাই, তখন তিনি আমার সৌভাগ্য কামনা করেছিলেন । অবশেষে আমি আমার পরিশ্রমের ফল পেলাম যখন তিনি সেই মিষ্টি কথাগুলি বললেন “আপনাকে একটি” F “চিহ্নিত পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে “। আমি তখন আমার উত্তেজনা সামলে রাখতে পারিনি। আমি বিশ্বের কাছে চিৎকার করতে চেয়েছিলাম যে আমি আমার নথিতে নিজেকে সনাক্ত করার অধিকার অর্জন করেছি। পরে, পুলিশ যাচাইকরণ শুরু হওয়ার কথা এবং বেশ কয়েকদিন ধরে আমাকে কোনও ফোন আসেনি, যা আমাকে জানানো হয়েছিল যে আমি পেতে পারি। আমার মা পুলিশ স্টেশনে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন । পরে একজন অফিসার আমার বাড়ি পরিদর্শনে এলেন । আমি আমার ঘটনা বলেছিলাম এবং আমার ট্রান্স পরিচয় প্রকাশ করেছিলাম , যা আমি মনে করি যে অফিসারের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল , তিনি ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ালেন।
শীঘ্রই আমার পাসপোর্টটি ছাপানো এবং স্পীড পোস্টের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল যা পৌঁছানোর জন্য দুই দিন বা তার বেশি সময় লাগল। এখন যখনই আমি আমার পাসপোর্টটি দেখি , তখন মনে হয় আমি স্বাধীকারের একটি পদক জিতেছি। আশা করি আপনারা সবাই এই যুদ্ধে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসবেন ।