
লিঙ্গ পরিচয় কি?
লিঙ্গ আমাদের পায়ের মাঝখানে কী আছে তা নয, সেটা আমাদের শারীরিক যৌন লক্ষণ । এটা এমন কিছু যা আমাদের মনের সাথে জড়িয়ে থাকে এবং ওতপ্রোতভাবে নিজেদের অস্তিত্বের সাথেই মিশে যায় । লিঙ্গ পরিচয় যেন আরও বেশী করে একজন ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক পরিচয়। লিঙ্গ পরিচয় তাদের নিজস্বতার এক অভিজ্ঞতা। এভাবেই আপনি নিজেকে চিনতে চান এবং চান যে সমাজ আপনাকে সেভাবেই চিনুক ও গ্রহণ করুক । এটি কিছু চরিত্র বা ব্যক্তিত্ব যা ওই ব্যক্তি যে সমাজে থাকে সেখানে উপস্থাপন করতে চায়। একজন ব্যক্তি এর উপর ভিত্তি করে তার সামাজিক সংযোগ স্থাপন করতে চায়। লিঙ্গ পরিচয়টি সহজাত মানব আচরণের একটি বৈশিষ্ট্য যা প্রভাবিত করে তার সামাজিক কার্যকলাপগুলিকে ।
এটিকে সহজতর করার জন্য আমাদের আরেকটি মানব বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ দিই যাতে মনুষ্যবিশেষে কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের একটি অধিক কার্যকরী হাত আছে। জনসংখ্যার বেশীরভাগের জন্য, এটি তাদের ডান হাত। কিন্তু জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট শতাংশের তাদের বাম হাত স্বাভাবিকভাবে অধিক কার্যকরী মনে হয়। মানুষের আরেকটি দলের জন্য, তাদের বাম হাত লেখা ছাড়া বাকী সবকিছুর জন্য বেশী প্রভাবশালী। মানুষের অন্য একটি দল উভয় হাত সমানভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম , তাই কোন হাতই অন্যটির থেকে বেশী কার্যকরী নয়। পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীগণ এই বিষয়ে অনেক গবেষণা করছেন। যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কতগুলি মৌলিক ধারণা রয়েছে, তবুও এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বুঝতে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন। ততদিন পর্যন্ত, মানুষের একটি হাতের আধিপত্য মানবজাতির আচরণের বৈচিত্র্য হিসাবে গণ্য হবে।
লিঙ্গ পরিচয়ের বিকাশ
একজন ব্যক্তির মূল লিঙ্গ পরিচয় দুই বা তিন বছর বয়সেই তৈরী হয়ে যায় । মানবিক ভাষায় কথা বলতে শেখার আগেই একটি শিশু তা বুঝে যায়। বিজ্ঞানীরা জানছেন কিভাবে একটি শিশুর মস্তিষ্কে লিঙ্গ পরিচয়ের ধারণা গঠিত হয়। কিন্তু সুস্পষ্ট কারণবশত শিশুরা এই বয়সে কোনও ভাষায় কথা বলে না, তাই বাচ্চাদের মধ্যে লিঙ্গ পরিচয় বিকাশ জানার কাজটা কষ্টসাধ্য ।

লিঙ্গ পরিচয় গঠন একটি জটিল প্রক্রিয়া। একটি শিশু এর লিঙ্গ পরিচয় বিকাশে অনেক কিছুরই অবদান থাকে । অনেক বিজ্ঞানী শিশুটির পরিবার ও বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলির ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন, যা লিঙ্গগত পরিচয গঠনে জৈবিক কারণগুলির তুলনায় বেশী প্রভাব ফেলে । এটি ‘প্রকৃতি বনাম বেড়ে ওঠা ‘ বিতর্ক হিসাবে পরিচিত হয়। সামাজিক- পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলি যেমন পরিবারে লিঙ্গগত ভূমিকা, পারিবারে প্রধান ব্যক্তিত্ত্ব , শিশুটির জীবন , ভাষা ইত্যাদি এক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। লিঙ্গগত পার্থক্যকে প্রভাবিত করে এমন কিছু জৈব কারণ থাকে যেমন মায়ের গর্ভে শিশুটির হরমোনের মাত্রা শিশুর জন্মের আগে, জন্মের পরে শিশুটির হরেমান মাত্রা, জেনেটিক গঠন, বাচ্চার জন্মের আগে বা পরে মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বিকাশ ।
ডঃ মানির লিঙ্গ পরিচয় পরীক্ষা
ডেভিড রেইমারের ঘটনাটি ‘প্রকৃতি বনাম বেড়ে ওঠা’ বিতর্কের একটি বিখ্যাত চিত্র। ডেভিড রেইমার এবং তার যমজ ভাই ব্রেইন রেইমার একদম অভিন্ন যুগল ছিল। সুন্নতের অপব্যবহারের কারণে, ডেভিড তার সম্পূর্ণ পুরুষ লিঙ্গ হারিয়ে ফেলে যখন তার বয়স ৭ মাস ছিল। যে সময় থেকে বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালের ডাঃ জন মানি যৌন বিকাশ ও লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে একজন সুপরিচিত অগ্রদূত ছিলেন, রেইমাররা ডেভিডকে ড: মানির কাছে নিয়ে যেতেন। ডাঃ মানি, জন্ম তত্ত্বের ক্ষেত্রে লিঙ্গ নিরপেক্ষতার একজন সমর্থক ছিলেন | তিনি বিশ্বাস করতেন যে শৈশবকালে সামাজিক শিক্ষা এবং সংস্কৃতির কারণে লিঙ্গগত পরিচয় মৌলিকভাবে বিকশিত হয় এবং প্রাসঙ্গিকভাবে আচরণগত, মনস্তাত্ত্বিক ও চিকিৎসা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা পরিবর্তিত হতে পারে।
ডেভিড যখন ২২ মাস বয়সী ছিল , ডাঃ ডেভিডের অর্কিয়েকটমি (শুক্রাশয় অপসারণ) করেছিলেন । মানি ডেভিডের পরিবারকে প্রস্তাব দেয় ডেডিডকে যেন তারা মেয়ের মত মানুষ করে তাকে এটা না জানিয়ে যে সে জন্মেছিল একটি পুরুষ শিশু হিসাবে । ডেভিডকে ব্রেন্ডা হিসাবে নামকরণ করা হয় এবং একটি মেয়ে সন্তান হিসাবে উত্থাপিত করা হয়, মেয়েলী জামাকাপড় পরানো হয় এবং মেয়েলী শিশুদের খেলনা দেওয়া হয় । ডাঃ মানি পরিবারটিকে প্রায়ই দেখতে যেতেন । তিনি নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য ব্রেন্ডাকে প্রশিক্ষণ দিতে চেষ্টা করেছিলেন । ডাঃ মানি প্রায়ই ব্রেন্ডাকে নারীসুলভ আচরণে বাধ্য করতেন এবং ব্রেন্ডার জীবনকে তার সাফল্য কাহিনী হিসাবে দেখাতে চাইতেন ।
ডাক্তার মানির জন্য, দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারনে এই কেসটি জন্ম নিরপেক্ষতার তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য একটি নিখুঁত পরীক্ষা ক্ষেত্র ছিল।
১) ডেভিড এর অভিন্ন যমজ ভাই ব্রেইন একই জিন , একই পারিবারিক পরিবেশ এবং একই আন্তঃজরায়ু পরিবেশ (গর্ভকালীন হরমোনগুলির প্রভাব ) লাভ করেছিল , ব্রেন্ডার ভাই ব্রেইন তাই পরীক্ষামূলক তুলনার জন্য চমৎকার টেস্ট কন্ট্রোল হয়ে উঠেছিল ।
২) ডেভিড জন্মের সময়ে তার যৌনাঙ্গে কোন ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা ছিল না এবং ডেভিড ইতিমধ্যেই ঘটে যাওয়া কোন সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য বোঝার জন্য খুবই ছোট ছিল।
অনেক বছর ধরে ডাক্তার মানি ডেভিডের ঘটনাটিকে একটি সুস্থ পুরুষ শিশুর মহিলা লিঙ্গ পরিচয় বিকাশের সফল কেস হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। ডাক্তার মানির সাফল্য কাহিনী উপর ভিত্তি করে, আরও অনেক ডাক্তার অনেক শিশুর উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন|
কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, ব্রেন্ডা গভীরভাবে অস্বস্তিতে ছিল। না রঙিন মেয়েলী পোশাক বা খেলনা না মহিলা হরমোন তাকে একটি মেয়ে করতে পারে।১৩ বছর বয়সে, সে তার বাবা-মায়ের কাছে এসে বলেছিল যে মেয়ে হিসাবে বাঁচার চেয়ে তার মরে যাওয়া ভালো । পরে তার বাবা-মা তার জন্মের সত্যিকারের ঘটনা এবং তার লিঙ্গ পরিবর্তন পরীক্ষার কথা তার কাছে প্রকাশ করে। ১৪ বছর বয়সে এটা জানার পর যে সে একটি পুরুষ যৌনাঙ্গ সহ জন্মগ্রহণ করেছিল , ব্রেন্ডা অস্ত্রোপাচার করে একটি পুরুষ গোপনাঙ্গ পুনর্নির্মাণ করে । ব্রেন্ডা পুরুষ লিঙ্গ পরিচয় গ্রহণ করে এবং ডেভিড হিসাবে বসবাস শুরু।
বর্তমান গবেষণার ফলাফল
আরও সাম্প্রতিক গবেষণা এবং তত্ত্বগুলি বলে যে, শিশুর লিঙ্গ পরিচয় নির্মাণে সামাজিক পরিবেশ খুব সামান্য ভূমিকা পালন করে। আমাদের লিঙ্গ পরিচয় বেশিরভাগ অন্তর্নিহিত। সমাজ বা পিতা মাতা হিসাবে, আমাদের বুঝতে হবে যে লিঙ্গ পরিচয় একটি পছন্দ বা ইচ্ছা নয়। এটা কখনোই ছিল না ও হবেও না । আমরা আমাদের লিঙ্গ পরিচয়ের বিপরীত লিঙ্গ হিসাবে বেঁচে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না । সংক্ষেপে, আমি আপনাদের সেই সমস্ত সত্যকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যা আমরা সবাই জানি তবে আমরা ভুলে যাই-
“লিঙ্গ আমাদের দুই পায়ের মাঝে কি আছে তা নয়, এটা আমাদের শারীরিক যৌন লক্ষণ। লিঙ্গ হল এমনকিছু যা আমাদের মস্তিষ্ক , আমাদের মন এবং আমাদের নিজ অস্তিত্ববোধের মধ্যে মিশে থাকে ।